
অনলাইন ডেস্কঃ
১৭ জুলাই ২০২৪। ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই। সামাজিক মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে রংপুরের অকুতোভয় ‘সৈনিক’ আবু সাঈদের প্রসারিত দু’হাত। বুলেটের সামনে পেতে দেওয়া বুক। আর তার শহীদ হওয়ার খবর। ভেসে বেড়াচ্ছে কলিজা ছেঁড়া আহাজারি ‘আমার বেটাক মারলু কেনে’। দেশের মানুষের ঘুম নেই। অস্থির, সবাই যেন পায়চারি করছে ফেসবুকে। স্ক্রলের পর স্ক্রল। বেদনার পর বেদনা। দেশের ঘাড়ে চেপে বসেছে দীর্ঘমেয়াদি অন্ধকার। কবে ভোর হবে জানা নেই কারো। নেই আশা, স্বপ্ন।
এমন পরিস্থিতিতে একটা গান মুক্তি পেল ইউটিউবে, ফেসবুকে। গান তো নয় যেন বারুদ, স্লোগান, লড়াইয়ের আহ্বান, যেন যুদ্ধের আগে দেওয়া খালিদের রক্ত গরম করা ভাষণ- ‘তোমার রক্তে হাজী শরীয়ত/ তুমি হলে তিতুমীর/ ভেঙে ফেলো সব বাধার প্রাচীর/ ছিঁড়ে ফেলো জিঞ্জির। ভোরের কিনারে তরী বেয়ে যাও/ ভুল ঘাটে ভিড়িয়ো না/ এখন সময় লড়াই করার/
জিরিয়ো না জিরিয়ো না। জেগেই যখন উঠেছো বন্ধু/ খালি হাতে ফিরিয়ো না/ এখন সময় লড়াই করার/ জিরিয়ো না জিরিয়ো না।’ গানের কথা লিখেছেন নুরুজ্জামান শাহ। নিয়ামুল হোসেনের সুরে গেয়েছেন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর একঝাঁক শিল্পী।

গানটা অদ্ভূত! প্রথাগত সুর, বাদ্যের অস্তিত্ব নেই। নেই নাটকীয়তা কিংবা নাটক। গ্ল্যামারাস তরুণ-তরুণীর অভিনয় নেই। মিউজিক ভিডিওর নামে অশ্লীলতা কিংবা ভাঁড়ামি নেই। আছে মশাল, মিছিল, স্লোগান। আছে রক্তে আগুন ধরিয়ে দেওয়া অসংখ্য উপাদান। স্বৈরাচারের ঘুম হারাম করা অস্ত্র। মসনদ নাড়িয়ে দেওয়ার সাহস। জনগণকে রাস্তায় নিয়ে আসা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুর।
গানে গানে লড়াইয়ের কথা বলে ঘরে বসে থাকা যায়। সাইমুমের শিল্পীরা তা করলেন না। আন্দোলনে মাঠের ভূমিকা নিয়ে সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর পরিচালক জাহিদুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, “আমরা ‘শিল্প ঐক্য ফোরাম’-এর ব্যানারে মাঠে নেমেছিলাম। ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ ও স্বৈরাচার পতনের গোটা আন্দোলনে শিল্পী গোষ্ঠীর সদস্যরা দিনে থাকতেন মাঠে, মিছিলে, স্লোগানে, বন্দুকের সামনে; রাতে থাকতেন গানে, কবিতায়, স্টুডিওতে, মাইক্রোফোনের সামনে। দিনভর আন্দোলন, রাতভর চলত গান।’
জাহিদুল ইসলাম জানান, সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা আন্দোলনে তরুণ সমাজকে আগ্রহী করে তুলতে গাইলেন ‘আয় আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উদগীরিত রই/ দুঃখ-শোকের মাঝেও চির উজ্জীবিত রই/ দু’কূল ভাঙা ঝড়ের মতো নৃত্য তুলে পায়/ আয় তারুণ্য আয়।’ আরও গাইলেন, ‘যদি কান্নার পরে আসে স্বস্তি’র মতো গান। গানগুলো আন্দোলনে তরুণদের মুখে পৌঁছে গেছে স্লোগানের মতো। আন্দোলনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইনে। অনলাইন, অফলাইন বিপ্লবীদের রিলসের বড় উপাদান ছিল সাইমুমের গান।
জাহিদ জানান, একটি রাষ্ট্র টিকে থাকে তিনটি ভিতের উপর। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি। বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে দূরে রেখে বাংলাদেশি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে ১৯৭৮ সালে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের হাত ধরে সাইমুমের জন্ম। গত ৪৭ বছর সাইমুম প্রকাশ করেছে একশ ২০টার বেশি অ্যালবাম, ১৫শ’র মতো গান, ৮০র বেশি মঞ্চনাটক এবং ২০-২৫টা নাটিকা। আছে অসংখ্য আবৃত্তি। দেশে ও দেশের বাইরে স্টেজ শো করেছে পাঁচ হাজারের বেশি। যন্ত্রের ব্যবহার না করে কেবল স্বরযন্ত্র ব্যবহার করে চলে তাদের হামদ, নাত, কাওয়ালী, আবৃত্তি ও ইসলামি গানের মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। শুধু ঢাকায় আছে শতাধিক শিল্পী। এছাড়া পাঞ্জেরী, দিশারী, অনুপম, জাগরণ, টাইফুন ইত্যাদি শিল্পীগোষ্ঠীর মতো সারা দেশে অঞ্চলভিত্তিক যত ইসলামি ভাবধারার শিল্পীগোষ্ঠী আছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও সব ধরনের সহযোগিতা করা হয় সাইমুমের পক্ষ থেকে।
ইসলাম ও ইসলামি সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করায় গত ১৫ বছর অবধারিতভাবে তাদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে অত্যাচারের স্টিমরোলার। জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গত পনেরো বছর আমাদের শিল্পীরা ৭০-৮০টা মামলা খেয়েছে। আমাদের সাবেক পরিচালক মাহমুদুল হাসান ভাই এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। ২০১৮ সালে র্যাব তার উপর এমন নির্যাতন করেছে, তার পায়ে ইনফেকশন হয়ে গেছে।’
সাইমুমের এই পরিচালক আরো বলেন, ‘স্বৈরাচারের প্রশাসন আমাদের অফিসে বারবার হানা দিয়েছে। আমাদের যত ক্যাসেট, অ্যালবাম ও অন্যান্য শিল্পসরঞ্জাম ছিল সব নিয়ে গেছে। র্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দিন ফারুক আমাদের সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে সেগুলোকে সরকারবিরোধী প্রচারণায় ব্যবহারের অভিযোগ দায়ের করেছে। এত বাধা-বিপত্তির পরেও আমরা থেমে থাকিনি।’
সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ (সসাস)-এর ব্যানারে দেশব্যাপী ‘সেরাদের সেরা’ নামে একটি রিয়েলিটি শোয়ের আয়োজন হয়। যে শোয়ের মাধ্যমে সারা দেশ থেকে তেলাওয়াত, হামদ, নাত, ইসলামি সংগীত, আবৃত্তি ও অভিনয় শিল্পী উঠে আসছে। এরই মধ্যে পাঁচটি সিজন সম্পন্ন হয়েছে এই রিয়েলিটি শোয়ের। এই শোর পাশাপাশি টেলিভিশনে যে কোনো ইসলামি অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করে সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী।
সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও কার্যক্রম জানতে চাইলে জাহিদুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা দেশ। এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। এখানকার মানুষের প্রাণের সংস্কৃতি হলো শাশ্বত ইসলামী মূল্যবোধের সংস্কৃতি। এই আদর্শবাদী সোনালি সংস্কৃতির চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী’। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষক মীর কাসেম আলীর তত্ত্বাবধানে এবং তরুণ কবি, সুরস্রষ্টা, গীতিকার ও শিল্পী মতিউর রহমান মল্লিকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সত্য-ন্যায়ের তূর্যবাদক এই সংগঠন। মননশীল সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার শুভার্থী মিয়া মোহাম্মদ আইয়ুব সংগঠনটির নাম দেন ‘সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী’।
বাংলাদেশে ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ সংগঠন হিসেবে সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর নাম সর্বজনবিদিত। সংগঠনটি বর্তমানে ছয়টি বিভাগীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে নিয়মিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলেছে। বিভাগগুলো হলো সংগীত, থিয়েটার, শিশু, কিশোর, তেলাওয়াত এবং আবৃত্তি ও উপস্থাপনা।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত বহু গুণী ব্যক্তি সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ, মাওলানা তারেক মনোয়ার এবং সাইফুল্লাহ মানসুর।
১৯৭৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর সাফল্য অনেক। সাইমুমের ছায়াতলে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক কর্মীরা জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাদের মধ্যে অনেকে কবি, সাহিত্যিক, কণ্ঠশিল্পী, কারি, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, অভিনেতা এবং সংগঠক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। এছাড়াও, ইসলামি চিন্তাবিদ, আবৃত্তিকার, নাট্যনির্দেশক, উপস্থাপক, সাংবাদিক এবং অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে মিডিয়া অঙ্গনে ছড়িয়ে আছেন এ সংগঠনের অনেক কর্মী।
অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রকাশনার ক্ষেত্রেও সাইমুমের অবদান অসাধারণ। সংগঠনটি এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টির অধিক অ্যালবাম প্রকাশ করেছে এবং ৪০টিরও বেশি মঞ্চনাটক মঞ্চস্থ করেছে। সাইমুমের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে ৩০ বছর পূর্তি স্মারক, মল্লিক স্মারক এবং সাহিত্য পত্রিকা ‘বাতায়ন’। চার দশকের পথচলায় সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী ইসলামি সংস্কৃতির প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে এবং আজও সেই পথ ধরে এগিয়ে চলেছে।